নাটোরের মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের বীরত্বগাথা যুদ্ধ ইতিহাসের এক গৌরবময় উপাখ্যান। জীবিত এবং শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কথা ও স্মৃতি থেকে জানা যায়, ২৭ নভেম্বর ১৯৭০ সালের পরপরই দেশপ্রেমিক নাটোরবাসী বঙ্গবন্ধুকে ভোট দেয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল। ৭ই ডিসেম্বর ১৯৭০ এমপি ও ১৭ই ডিসেম্বর ১৯৭০-এ এমএলএ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করা সত্ত্বেও ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় দেশের অন্যান্য স্থানের জনগণের মত নাটোরের জনসাধারণের মধ্যেও তীব্র জনরোষের সৃষ্টি হয়। প্রকৃতপক্ষে মিছিল, আন্দোলন ও প্রতিরোধের বহিঃপ্রকাশ ফেব্রুয়ারী/১৯৭০ এর প্রথম দিকেই শুরু হয়েছিল। ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ভাষন দেন। তৎকালীন নাটোরের মাননীয় এমপি বাবু শংকর গোবিন্দ চৌধুরী, মাননীয় এমপি জনাব আশরাফুল ইসলাম, মাননীয় এম এন এ ডাঃ মোবারক হোসেন এবং জনাব সৈয়দ মোতাহার হোসেন সহ আরো বেশ কয়েকজন ঢাকায় গমন করে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ শুনেছিলেন। এ ভাষন নাটোরের জনগণের মাঝেও গণজাগরনের সৃষ্টি করেছিল এবং তা ক্রমে ক্রমে তীব্র হয়ে উঠেছিল। বঙ্গবন্ধুর সে ভাষণের নির্দেশনা অনুযায়ী ৯ই মার্চ থেকে নাটোরে সংগ্রাম পরিষদ গঠন শুরু হয়। প্রথমে বাগাতিপাড়া এবং পরে নাটোর সদর ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় অনেকগুলো সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। প্রতিদিন শত শত মানুষের মিছিল হতে থাকে।
মার্চ, ঊনিশ’শ একাত্তর। উত্তাল সারাদেশ। মুক্তিপাগল বাঙালী যখন স্বাধীনতা আদায়ের লক্ষ্যে জীবন দিতে প্রস্ত্তত, পাকহানাদার বাহিনী নিজেদের অস্তিত্ব বিপন্ন জানতে পেরে, তখন সারা বাংলায় নিরীহ বাঙালীর উপর নিপীড়ন, নির্যাতন, ধ্বংস ও হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছিল। তা থেকে রেহাই পায়নি নাটোরের লালপুর থানার ধলা গ্রামটিও।
২৯টি পরিবারের সুখে বসবাস ছিল ‘ধলা হিন্দুপাড়ায়'। মুহূর্তের মধ্যে সর্বশান্ত ও নিঃস্ব হয়ে যায় প্রায় সকল পরিবার। তার মধ্যে ২২টি পরিবার বিশেষ নিরাপদ স্থানে আত্ম রক্ষার্থে সরে গিয়েও বাঁচতে পারেনি গৃহকর্তারা। প্রাণ হারাতে হয়েছিল একই সারিতে।
১ মে ১৯৭১, তখন বাজে প্রায় সকাল ১১ টা। প্রতিদিনের মতো নিত্যকর্মে ব্যস্ত ধলা গ্রামবাসী। আকস্মিক ভাবে শুরু হলো এক বিভীষিকাময় এবং শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। কতিপয় পাক দোসরদের উস্কানিতে কিছু দুষ্কৃতিকারী ধলাবাসীদের উৎখাতের উদ্দেশ্যে প্রথমেই রজনীকান্তের বাড়ীতে অগ্নি সংযোগ করে। দিনটি মেঘাচ্ছন্ন, গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি থাকায় আগুন ছড়াতে পারেনি। পোড়ার হাতথেকে গ্রামটি রক্ষা পেলেও লুটতরাজ হামলাকারীদের হাতে নারী, পুরুষ, বৃদ্ধ, শিশুরা নিষ্ঠুর নির্যাতন ও অত্যাচারের শিকার হয়েছিল। এসব থেকে বাদ পড়েনি গোয়ালে বাঁধা গরু-মহিষগুলোও। ঐ সময় প্রাণে বাঁচার জন্য গ্রামের কিছু যুবক আশে-পাশে ঝোপ-ঝাড়ে লুকিয়ে আত্মরক্ষা করে। সেদিনের এ তান্ডব চলে বেলা ২ টা পর্যন্ত।
সহায় সম্বলহীন হয়ে তারা শুধুমাত্র এক কাপড়ে জীবন রক্ষার্থে পরবর্তী সময়ে একত্রিত হতে থাকে, নিরাপদ আশ্রয় প্রাপ্তির প্রত্যাশায় বনপাড়া মিশন অভিমুখে যাত্রা করে। হরিপদ-এর স্ত্রী আলো রাণী অত্মঃস্বত্বা থাকায় পথিমধ্যে প্রসব ব্যাথা উঠে। ধলাগ্রাম সংলগ্ন বড়াইগ্রাম থানার মানিকপুর গ্রামে বারেক ফকিরের বাড়ীতে বিকেলে একটি কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। ফলে তাদের সাময়িক যাত্রা বিরতি ঘটে।
সন্ধ্যায় সদ্য ভূমিষ্ট শিশু কন্যা বুনুসহ ধলা গ্রামবাসী বনপাড়া মিশনে ফাদার পিনোস-এর শরাণাপন্ন হয়। ফাদার দায়িত্ব নিয়ে তাদেরকে মিশন ক্যাম্পাসে কনভেন্টে রাখার ব্যবস্থা করেন। তৎপূর্বে মিশন সংলগ্ন এলাকার সেকচিলান, কদিমচিলান, ওয়ালিয়া, চন্ডীপুর, দিয়ারপাড়া এমন কি নাটোর শহরের কতিপয় মানুষও প্রাণ ভয়ে আশ্রয় নিয়েছিল বনপাড়া মিশনে।
ইতোমধ্যে ধলা গ্রামের কয়েকটি পরিবার মিশনে না গিয়ে আত্মরক্ষার জন্য হারোয়া গ্রামের মহর মোল্লাসহ কয়েকজনের সহায়তায় ভারত অভিমুখে রওনা হয়ে যায়। অবিরাম বৃষ্টি থাকায় অনেকেরই ইচ্ছা থাকা সত্বেও সহযাত্রী হতে পারেনি।
দু’দিন মিশনে অবস্থানের পর, ৩ মে ১৯৭১ বিকাল প্রায় ৩ টায় হঠাৎ পাক হানাদার বাহিনী মিশন ক্যাম্পাস ঘিরে ফেলে। তার কিছুক্ষণ পূর্বে বনপাড়া এলাকা থেকে কয়েকজন খ্রীষ্টান যুবককে আটক করে নিয়ে আসে। ফাদার পিনোস ও অন্যান্য ফাদারদের অনুরোধে হানাদার বাহিনীরা খ্রীষ্টান বলে ছেড়ে দেয় কিন্তু মিশনের ভেতরের হিন্দুদের অবস্থান জেনে মিশনের অফিস, হোস্টেলসহ সর্বত্র তল্লাশি করে ধলা গ্রামের ২২ জনসহ অন্যান্য স্থানের আশ্রিত পরিবারের ৮৬ জন যুবক ও মধ্যবয়সী পুরুষকে আটক করে এবং সেই সাথে কয়েকজন নারীকে ট্রাকে তুলে নেয়। তাদের সবাইকে রক্ষার জন্য ফাদার পিনোস-এর পুনঃ পুনঃ অনুরোধ উপেক্ষিত হয়। সেই মুহূর্তে সিস্টার কারমেলা মেজর শেরওয়ানীর পা চেপে ধরেন এবং অনেক কাকুতি-মিনতি করার পর শেষ পর্যন্ত শুধু নারীদের ছেড়ে দেয়।
পাক বাহিনী ঐ দিন সন্ধ্যায় আটক ৮৬ জনকে নাটোর দত্তপাড়া সংলগ্ন ফতেঙ্গাপাড়ায় নারদ নদের সংযুক্ত খালের পার্শ্বে নিয়ে গুলি চালিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। আটকদের মধ্যে অনীল নামক একজন গুলিবিদ্ধ হয়েও অলৌকিক ভাবে প্রাণে বেঁচে যায়। লাশগুলোকে মাটি চাপা দিয়ে রাখা হয়েছিল যে স্থানে সেই খালের পার্শ্বে সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ছোট্ট একটি স্মৃতিস্তম্ভ।
এদিকে পাক সেনাদের হুমকি ও চাপের কারণে ফাদার পিনোস আশ্রিতদের রাখার জন্য অপারগতা প্রকাশ করেন। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ৩ মে, রাত প্রায় ১০টায় সহায় সম্বলহীন স্বামী হারা হতভাগীরা তাদের অপ্রাপ্ত শিশু ও বৃদ্ধসহ নিরুপায় হয়ে পুনরায় মানিকপুরে ফিরে যায়। তখন মানিকপুরে জুমন প্রামানিক, পাচু মোল্লা, বারেক ফকির, গফুর ফকির, আজিম উদ্দিন, আফছার আলী প্রমূখ ব্যক্তিরা সহমর্মিতা প্রকাশ করে। তারা সাধ্যমত খাদ্য সামগ্রী এবং কিছু কাপড়-চোপড় দিয়ে ভয়ার্ত মানুষগুলোকে বাঁচতে সাহস জুগিয়ে নিজ নিজ বাড়িতে উঠিয়ে দেয় এবং নিরাপদ পাহারার ব্যবস্থা করে। ধলাবাসীকে আশ্রয় ও সহযোগিতা করার কারণে কতিপয় পাক দোসররা মানিকপুর বাসীকে পরের দিন অর্থাৎ ৪ মে চাপ সৃষ্টি করে এবং ফিরে আসা হিন্দুদের উপর পুনরায় ভয়ভীতি প্রদর্শন করে।
উপায়ন্ত না দেখে অনতিবিলম্বে মানিকপুরবাসীর গোপন সহায়তায় নিজ বাড়ী ছেড়ে কেউ কেউ বড়াইগ্রাম থানার দ্বারিকুশি গ্রামের ঝড়ু সরকার, রাধাকান্ত সিকদার (টেংগর), গৌরাঙ্গ প্রামাণিক এবং গুরুদাসপুর থানার সিধূলী গ্রামের অধীর, শচীন, সুমমত্ম, রজনীকান্ত প্রমূখ স্বজনদের কাছে আশ্রয় গ্রহণ করে। উল্লেখিত প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থানকালীন সময়ে সিধূলী গ্রামের রাজা শাহ্, জাকির হোসেন, আফাজ উদ্দিন এবং দ্বারিকুশি গ্রামের আব্দুস সামাদ সরকার, মছের সরকার এবং জাবেদ আলী প্রমূখ সংশ্লিষ্ট গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়সহ ধলার আশ্রিতদেরকেও নিরাপদে আগলে রাখেন। এমনিভাবে পার হয়ে যায় নয় মাস।
মহান মুক্তিযুদ্ধ ও লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে দেশ হলো স্বাধীন। নিঃস্ব অবস্থায় কিছুদিনের মধ্যে ফিরে এলো ধলা গ্রামবাসী। ফিরে এসে পেল শুধুমাত্র সুধীরের বাড়ীর জানালা-দরজা বিহীন তিনটি ঘর আর বাকী সবই ঘুঘুচড়া ভিটা। খোলা আকাশে নিচে তাবু খাটিয়ে নতুন করে জীবন চলা শুরু করল বেঁচে থাকা মানুষগুলো স্বাধীন দেশের মাটিতে। সেই থেকে এলাকাবাসীর কাছে ধলা একত্তরের ‘বিধবা গাঁ’।
পাক বাহিনীর হাতে নিহত ধলাগ্রামের ২২ ব্যক্তিঃ
শচীন চন্দ্র দাস গৌরপদ
কার্ত্তিক সরকার গোপেশ্বর সরকার
বীরেশ্বর অনাথ বন্ধু
বৈদ্যনাথ মজুমদার রবি সরকার
বাসুবেদ কবিরাজ বাসুদেব মন্ডল
বীরেন্দ্র নাথ সরকার শান্তি নারায়ণ সরকার
দুলাল প্রামানিক সুরেন সরকার
কাশিনাথ প্রামানিক মনোরঞ্জন
সন্তোষ সরকার যতীন প্রামাণিক
ননী গোপাল নারায়ণ চন্দ্র সরকার
অবিনাশ সরকার হরিপদ সরকার
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস