কবির কল্পনায় নাটোর অমর হয়ে আছে কাব্যে। প্রাচীন ঐতিহ্য ও প্রত্নতাত্ত্বিক ঐশ্বর্য্য মন্ডিত বরেন্দ্র ভূমি সংলগ্ন নাটোর জেলা। ২৪.২৬০ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৯.৯০ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে নারদ নদের উত্তর তীরে নাটোর শহর অবসিহত। আধুনিক কালের এ শহরটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের ঐতিহ্য সমৃদ্ধ এক অধ্যায়। একে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল এ অঞ্চলের সর্ববৃহৎ সামন্তরাজ ও এক মহীয়সী নারীর রাজ্য শাসন ও জনকল্যান ব্যবস্থা। কথিত আছে মোঘল আমলের পাঠান জমিদার লস্কর খাঁ তাঁর সৈন্য সামন্তদের জন্য যে সহান (বর্তমান পুঠিয়া এলাকা) হতে রসদ সংগ্রহ করতেন, কালক্রমে তার নাম হয় লস্করপুর পরগনা। এই পরগনার একটি নীচু জলাভূমির নাম ছিল ছাইভাংগা বিল। ১৭১০ সনে রাজা রাম জীবন রায় এ সহানে মাটি ভরাট করে তার রাজধানী সহাপন করেন। কালত্রুমে তা প্রাসাদ, দীঘি, উদ্যান, মন্দির ও মনোরম অট্রালিকা দ্বারা সুসজ্জিত নগরিতে পরিনত হয়। মোঘল আমলের কিছুকাল বর্তমান নাটোর জেলার গুরতদাসপুর উপজেলার চাপিলা গ্রামে চাপিলা পরগনার কেন্দ্র এবং পরবর্তীতে জেলা সদর ছিল বলে জানা যায়। পরে চাপিলা অস্বাস্থ্যকর স্থান বিবেচিত হওয়ায় জেলা সদর নাটোরে স্থানান্তরিত হয়। ১৮২১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত নাটোরে বৃহত্তর রাজশাহী জেলার সদর কার্যালয় ছিল। স্বাস্থ্যগত কারণে বিশেষকরে ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাবের কারণে ইংরেজ সরকার ১৮২১ খ্রিস্টাব্দে জেলা সদর নাটোর হতে রামপুর বোয়ালিয়ায় (বর্তমান রাজশাহী) স্থানান্তর করেন। নাটোর মহকুমা সৃষ্টি হয় ১৮৪৫ সালে। নাটোরকে স্বাস্থ্যকর করে গড়ে তোলার জন্য ১৮৬৯ সালে নাটোর পৌরসভা স্থাপিত হয়। ১৯৮৪ সালে নাটোর মহকুমা থেকে জেলায় রূপান্তরিত হয়।
কথিত আছে যে, বর্তমান নাটোর শহরের উপরেই এক সময় চলন বিল বিস্তৃত ছিল। জনৈক রাজা নৌকাপথে সেই স্থানের নিকট দিয়ে যাবার সময় একটি বেঙ কর্তৃক সাপকে ধরা দেখে নৌকার মাঝিদের ‘নাও ঠারো’- অর্থাৎ নৌকা থামাও; মতান্তরে ‘ন ঠারো’- অর্থাৎ নৌকা থামিও না বলেন। এরূপ বলার কারণ, তখন জলপথে দস্যু-তস্করের আক্রমন হতো। তারাও দস্যু কবলিত হতে পারেন- এই আশংকায় তাড়াতাড়ি উক্ত স্থান ত্যাগ করাই হয়তো শ্রেয় মনে করেন। আবার হিন্দু ধর্মমতে বেঙ সাপকে ধরলে মনসাদেবী ক্রোধান্বিত হন। সুতরাং নৌকা থামিয়ে মনসা পুজা করাই হিন্দু রাজার পক্ষে অধিক সংগত। তাই জন্য ‘নাও ঠারো’ অথবা ‘ন ঠারো’ কথা হতেই নাটোর নামের উৎপত্তি হয়েছে বলে অনুমান করা হয়।
ঐতিহাসিকদের মতে অষ্টাদশ শতকে নাটোর রাজবংশের উৎপত্তি। উত্তরবংগের জমিদারগনের মধ্যে নাটোর রাজ মান-মর্যাদা ও বিষয় সম্পত্তিতে ছিলেন অগ্রগন্য। রাজা রামজীবন রায় নাটোর রাজ বংশের প্রতিষ্ঠাতা। রামজীবনের পালিত পুত্র রামকান্ত রায়ের সাথে বগুড়া জেলার ছাতিয়ান গ্রামের আত্মারাম চৌধুরীর একমাত্র কন্যা ভবানীর বিবাহ হয়। রাজা রামজীবন রায় ১৭৩০ সালে মৃত্যুবরন করেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি রামকান্ত রায়কে রাজা এবং দেওয়ান দয়ারাম রায়কে তার অভিভাবক নিযুক্ত করেন। রামকান্ত রাজা হলেও প্রকৃত পক্ষে সম্পূর্ণ রাজকার্যাদি পরিচালনা করতেন দয়ারাম রায়। তাঁর দক্ষতার কারনে নাটোর রাজবংশের উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি ঘটে। ১৭৪৮ সালে রাজা রামকান্ত পরোলোকগমন করেন। স্বামীর মৃত্যুর পর রাণী ভবানী জমিদারী পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহন করেন। নাটোরের ইতিহাসে তিনি জনহিতৈষী মহারাণী হিসাবে অভিহিত এবং আজো তাঁর স্মৃতি অম্লান। বাংলার স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ্-দৌলার সংগে রাণী ভবানীর আন্তরিক সুসম্পর্ক ছিল। কথিত আছে পলাশীর যুদ্ধে রাণী ভবানী নবাবের পক্ষ অবলম্বন করেন।
পরবর্তীতে রাণী ভবানী নায়েব দয়ারামের উপরে সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে দিঘাপতিয়া পরগনা উপহার দেন। দিঘাপতিয়ায় প্রতিষ্ঠিত বর্তমান উত্তরা গণভবনটি দয়ারামের পরবর্তী বংশধর রাজা প্রমদানাথের সময় প্রতিষ্ঠিত হয়। কালক্রমে এই রাজপ্রাসাদটি প্রথমতঃ গভর্নর হাউস ও পরবর্তীতে বাংলাদেশের অভ্যূদয়ের পরে উত্তরা গণভবনে পরিনত হয়।
দিঘাপতিয়া রাজবংশ ও রাজবাড়ী
ঐতিহ্যের জৌলুস, অতীতের রাজ-রাজন্যের স্মৃতি, প্রাচীনত্ব আর ইতিহাসের সোনালি দিনগুলোকে বুকে ধারণ করে নীরব সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে নাটোরের দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি। প্রাচীন ঐতিহ্য আর প্রত্নতাত্ত্বিক ঐশ্বর্যমন্ডিত তিলোত্তমা এই রাজবাড়ি নাটোরকে এনে দিয়েছে এক বিশেষ খ্যাতি ও পরিচিতি।
বাংলার রাজা-জমিদারদের মধ্যে দিঘাপতিয়া রাজবংশ একটি উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করে আছে। দয়ারাম রায় এই রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। ১৬৮০ সালে নাটোরের প্রখ্যাত কলম গ্রামের এক তিলি পরিবারে দয়ারাম রায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম নরসিংহ রায়। নাটোর রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা রামজীবন যখন পুঠিয়ার রাজা দর্পনারায়ণের অধীনে চাকুরী করতেন, সে সময় তিনি কাজ উপলক্ষে চলনবিল এলাকার কলম গ্রামে পৌঁছেন। সে সময় দু’জন বালক রাজা রামজীবনের নৌকার সামনে উপস্থিত হয়। দুটি বালকের মধ্যে একজনের কথাবার্তা ও বুদ্ধির পরিচয় পেয়ে তিনি বালকটিকে নাটোরে নিয়ে আসেন এবং মাসিক আট আনা বেতনে চাকুরীতে নিয়োগ করেন। পরে সামান্য লেখাপড়া শিখে জমা-খরচ রাখার মতো যোগ্যতা অর্জন করেন এবং রামজীবন তাকে মাসিক ৮ আনার পরিবর্তে ৫ টাকা বেতনের মুহুরী নিযুক্ত করেন। পরবর্তীতে পুঠিয়ার রাজা দর্পনারায়ণ স্নেহ, ভালোবাসা ও সহানুভূতি, নবাব সরকারে ভ্রাতা রঘুনন্দনের প্রভাব-প্রতিপত্তি এবং বাংলার নবাব দেওয়ান মুর্শিদকুলী খাঁনের নেকনজর- সবকিছু মিলে যখন রামজীবন জমিদারী লাভ করেন, তখন রামজীবনের সঙ্গে সঙ্গে দয়ারামেরও ভাগ্য খুলতে থাকে। তিনি প্রথমে রাজা রামজীবনের একজন সাধারণ কর্মচারী থাকলেও প্রতিভা, দক্ষতা আর বিশ্বস্ততা দিয়ে নাটোর রাজের দেওয়ান পর্যন্ত হয়েছিলেন। রাজা রামজীবন তাকে অত্যন্ত বিশ্বাস করতেন এবং প্রচুর অর্থ-সম্পদ তার কাছে গচ্ছিত রাখতেন। রাজা সীতারাম রায়ের পতনের পর দয়ারাম রায় নাটোর রাজ্যের একজন পরাক্রমশালী ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। যশোরের রাজা সীতারাম রায় বিদ্রোহী হলে নবাব মুর্শিদকুলী খাঁ নাটোর রাজের দেওয়ান দয়ারাম রায়ের সাহায্যে তাকে দমন ও পরাজিত করে নাটোর কারাগারে বন্দি করে রাখেন। সীতারাম রায়কে পরাজিত করায় নবাব সরকারে দয়ারামের প্রভাব বেড়ে যায় এবং তিনি ‘‘রাই রাইয়া’’ খেতাবে ভূষিত হন। সীতারাম রায়কে পরাজিত করে তিনি তার মূল্যবান সম্পদসমূহ লুণ্ঠন করেন। কিন্তু সীতারামের গৃহদেবতা কৃষ্ণজীর মূর্তি ছাড়া সব রামজীবনের হাতে অর্পণ করেন। দয়ারামের এহেন ব্যবহারে রামজীবন খুশি হয়ে দয়ারামকে কৃষ্ণজীর মূর্তি স্থাপনের জন্য পুরস্কারস্বরূপ দিঘাপতিয়ায় একখন্ড জমি দান করেন এবং বর্তমান বগুড়া জেলার সারিয়াকান্দির চন্দনবাইশা এলাকার নওখিলা পরগনা দান করেন। এটাই দিঘাপতিয়া রাজবংশের প্রথম জমিদারী। পরে তিনি লাভ করেন পরগনা ভাতুরিয়ার তরফ নন্দকুজ্বা, যশোরের মহল কালনা ও পাবনা জেলার তরফ সেলিমপুর। এভাবেই দিঘাপতিয়া রাজবংশের ও জমিদারীর গোড়াপত্তন হয় ১৭৬০ সালে। ৮০ বৎসর বয়সে ৫ কন্যা, ১ পুত্র ও প্রচুর ধন-সম্পদ রেখে রাজা দয়ারাম রায় ইহলোক ত্যাগ করেন। তিনিই প্রথমে ‘‘উত্তরা গণভবন’’ খ্যাত দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি নির্মাণ করেন।
নাটোরের ঐতিহ্য কাঁচাগোল্লা। ভোজনরসিকদের কাছে কাঁচাগোল্লা সত্যিই লোভনীয় ও উপাদেয় একটি মিষ্টান্ন। কাঁচাগোল্লা তৈরীতে গরুর খাঁটি দুধ থেকে প্রাপ্ত কাঁচা ছানা সরাসরি ব্যবহার করা হয় বলে মিষ্টান্নটিকে কাঁচাগোল্লা নামে অভিহিত করা হয়েছে। কাঁচাগোল্লা স্বাদে অতুলনীয় এবং এর কাঁচা ছানার মোহনীয় মিষ্টি গন্ধে রসনাবিলাসীদের মন পরিতৃপ্তি লাভ করে।
কাঁচাগোল্লা তৈরির ইতিহাস:
নাটোরের কাঁচাগোল্লা সম্পর্কে সঠিক ইতিহাস জানা না গেলেও প্রচলিত জনশ্রুতি থেকে যা জানা যায় তা হল যে, প্রায় আড়াইশো বছর আগে নাটোরের লালবাজারে মধুসূদন নামে এক ব্যক্তির ছিল প্রসিদ্ধ মিষ্টির দোকান। দোকানে বেশ কয়েকজন মিষ্টি তৈরির কারিগর কাজ করত। মধুসূদনের মিষ্টির দোকানে প্রতিদিন প্রায় দেড় থেকে দু’মণ ছানা দিয়ে রসগোল্লা, পানিতোয়া, চমচম, কালো জাম প্রভৃতি মিষ্টি তৈরি করা হত। অনির্দিষ্টকারনে একদিন মিষ্টি তৈরির কারিগর দোকানে অনুপস্থিত থাকায় দোকানের মালিক মধুসূদন চিন্তায় পড়ে যায়। কারণ সেদিনও মিষ্টি তৈরির জন্য দোকানে অনেক ছানা তৈরি করে রাখা ছিল। মিষ্টির ছানাগুলো নষ্ট হয়ে যাবে এই আশংকায় মধুসূদন নিরুপায় হয়ে অগত্যা ছানাতে চিনির রস ঢেলে অল্প আঁচে জ্বাল দিতে থাকে। চিনির রসে ছানা আঠালো ও থকথকে হয়ে এলে চুলা থেকে নামিয়ে ঠান্ডা করে চেখে দেখার পর মধুসূদন যারপরনাই বিস্মিত ও আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে পড়ে। কারণ নতুন উদ্ভাবিত কাঁচাগোল্লার স্বাদ রসগোল্লা, পানিতোয়া, এমনকি অবাক সন্দেশকেও হার মানিয়ে দেয়।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস